গম্ভীরা গান। শতবর্ষ পূর্বে গম্ভীরা পূজার সঙ্গে আজকের গম্ভীরা গানের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ তখন আহারা'র সঙ্গে যুক্ত সামাজিক জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হত প্রশ্ন - উত্তর এর মাধ্যমে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের পর লোকসমাজের রুচির তাগিদে এটি লোক -নাট্যের রূপ নিয়েছে।
গম্ভীরা গানে সমাজনীতি ,রাজনীতি ও ধর্মনীতির প্রতিফলন ঘটেছে। গ্রামের নিরক্ষর ও অর্ধশিক্ষিত লোক -কবিরা গম্ভীরা গানের মধ্য দিয়ে সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধ্যে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এক সময় বহু লোক -কবি ও শিল্পীকে স্বদেশী আন্দোলনের জন্য বিদেশী সরকারের কোপানলে পড়ে শাস্তি পেতে হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তো গান স্তব্ধ হয়ে যায়েনি। তারা বিভিন্ন সময় পারিপার্শ্বিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে চলেছেন।
গম্ভীরা গানের অনুষ্ঠানে কয়েকটি ভাগ আছে। _________মুখপাদ ,বন্দনা ,দ্বৈত ,চরাইয়ারী , পালাবন্দী গান ,খবর বা রিপোর্ট। আদিতে এ গানের অনুসঙ্গ ছিল ঢোলক ,পরবর্তীকালে হারমোনিয়াম ,বাঁশি ,তবলা ও জুড়ি'ও যুক্ত হয়ছে। তবে গানের সঙ্গে সংলাপ ও রঙ্গরসিকতায় সেটি লোক -নাট্যের এক বলিষ্ঠ প্রতিনিধি হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিভিন্ন সুরের সংমিশ্রণে গম্ভীরা গানের সুর সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে আলকাপ ,রামপ্রসাদী ,বাউল ,কীর্তনের ঢং ও আছে। তবে এর সুর সৃষ্টিতে অমৃতি গ্রামের লোহারাম খালিফার অবদান সর্বাধিক। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়বস্তু থেকে ধর্মনিরপেক্ষ জগতে এ গানকে আনার ব্যাপারে দুই মুসলীম গম্ভীরা গান লেখক মহম্মদ সুফী ও সেখ সোলেমানের কৃতিত্ব সর্বাধিক। মালদার লোকায়ত ভাষায় আবাল -বৃদ্ধ -বনিতাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তুতে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে হাস্য রসের মোড়কে এ গান এক অনন্য লোক -শিক্ষার মাধ্যম সন্দেহ নেই। এ পর্যন্ত উল্লেখ্য রচনাকারের মধ্যে রয়েছেন হরিমোহন কুন্ডু ,মহম্মদ সুফী ,সেখ সোলেমান ,সতীশ কবিরাজ ,গোপীনাথ শেঠ প্রমূখ ব্যাক্তিরা।
স্বরাজ যদি পাই হে ভোলা
খ্যাতে দিব মানিককলা ,নইলে আইট্যা কলা
বানিয়া হইল দ্যাশপতি ,কি বলব ভাই দ্যাশের গতি।
কাঁচ দিয়ে কাঞ্চনাদি নেয় (যেন )হাতে দিয়ে মাটির খোলা। মালদার গম্ভীরা গানের মধ্য দিয়ে লোক -কবিরা পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। গম্ভীরা গানে লোক -কবিদের মধ্যে যেমন জাতীয়তাবোধের উন্মেষ দেখা যায়ে অপর দিকে ,সংকীর্ণ ধর্মীয় সংস্কারের উর্দ্ধে তাদের সমাজ সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। অনার্য সমাজে লৌকিক শিবের কৃষিকার্য ও ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন আমরা এই গানের মধ্যে দেখতে পাই। এখানে শিব উর্বরতা বৃদ্ধির দেবতা হিসেবে পরিচিত। এই শিব'ই রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে।
