মালদা জেলার ইংরেজবাজার ও পূরাতন মালদার অনেক গ্রামে শস্য ফলনের পালা ________ভাজোই গানের পালা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই পার্বন অনুষ্ঠান কালে অর্থাৎ ভাদ্রমাসে অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেয়েরা নিজেদের পছন্দ মত বিষয়বস্তু অবলম্বন করে নাচ-গান -অভিনয়াদি করতেন।
বর্তমানে ,ভাজোই গান -ভাজোই অনুষ্ঠান খুব কম পরিবারে অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েরাও সেক্ষেত্রে নিজেরা অভিনয় করেনা বললেই চলে। গৃহস্থ বাড়ির ভিতরে ,গোপনে মেয়েরা পালাভিনয়ের ব্যবস্থা করতেন। যাতে অভিনয়কালে কোনভাবে পুরুষরা উপস্থিত থাকতে না পারেন সে জন্য আগে ভাগেই ব্যবস্থা করা হত। তবে পুরুষদেরও ভাজোই গানের পালার ক্ষেত্রে সমর্থন বা অধ্যেষণ -এর অভাব ছিলনা।
নাচ -গান - বাজনা - সংলাপ এর সাথে অভিনীত পালাগুলি মেয়েরা নিজেরাই বাঁধতেন। সাধারনত ঢোলক ও জুড়ি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত।
চরিত্র অনুযায়ী নিজেরাই সাজসজ্জা করতেন। এই পালাগুলিকে 'ভাজোই গানের পালা ' বা 'মেয়েদের গম্ভীরা 'বলা হত।
শস্য ফলনমূলক ,নারীকেন্দ্রিক ব্রতানুষ্ঠানের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে এই লোকনাট্যে যৌনাচারসূচক অঙ্গভঙ্গির উপাদানের কথা অনুমান করা অসঙ্গত নয়। বিশেষ ভাবে বলা দরকার ,যে , গ্রামীন নারীসমাজের নিজস্ব উদ্যোগে রচিত ও প্রযোজিত লোকনাট্যের নিদর্শন দুর্লভ। এদিক থেকে ,গ্রামীন নারীসমাজের বিশেষ সৃষ্টিমুলকতার নিদর্শন হিসাবে 'মেয়েদের গম্ভীরা 'র গুরুত্ব আছে।
এরূপ দুটি পালা হল :_______________
পালা ১::চুড়িওয়ালা ও গৃহস্থবধূ
পালা ১::চুড়িওয়ালা ও গৃহস্থবধূ
চুড়িওয়ালা :: আমি কাঁচের চুড়ি ফেরি করি
বেড়াই লোকের বাড়ি বাড়ি
তোরা চুড়ি লিবিগে।
গৃহবধূ :: এসো এসো চুড়িয়ালা
এসো আমার বাড়ি
যদি থাকে মনের মতো
চুড়ি লিতে পারি।
চুড়িওয়ালা :: আমি কাঁচের চুড়ি ফেরি করি
বেড়াই লোকের বাড়ি বাড়ি
তোরা চুড়ি লিবিগে..........
আছে চুড়ি বেলুয়ারী আর হীরাকাট
আয়না বসা কাঁচের রুলি ,বসন্ত বাহার
আমি বলব কতোই আর।
গৃহবধূ :: এসো এসো চুড়িয়ালা
এসো আমার বাড়ি
যদি থাকে মনের মতো
চুড়ি লিতে পারি।
চুড়িওয়ালা :: আমি কাঁচের চুড়ি ফেরি করি
বেড়াই লোকের বাড়ি বাড়ি
তোরা চুড়ি লিবিগে..........
আছে চুড়ি বেলুয়ারী আর হীরাকাট
আয়না বসা কাঁচের রুলি ,বসন্ত বাহার
আমি বলব কতোই আর।
গৃহবধূ :: আমার স্বামী নাই বাড়িতে
গেছেন তিনি ছোঞ্চ আনিতে।
টাকা পয়সা নাইকো হাতে
গেছেন তিনি ছোঞ্চ আনিতে।
টাকা পয়সা নাইকো হাতে
উপায় কি করি।
এসো আমার বাড়ি।।
এসো আমার বাড়ি।।
চুড়িওয়ালা :: তুমি এসে বোসনা ,দাম লাগবে না
কি কি লিব্যা বলো না।
চুড়ি আছে ডালিম দানা।।
পালা ২:: নদীর ঘটে যেতে যেতে গৃহস্থ নারীগণের কথোপকথন
জনৈকা বধূ : দিদি দেখতো ভালা /এ কুন জ্বালা /ক্যামনে যাবে হাঁট
ঐ রজনা মিনসা /উইড়া আসা /ঘেরলে ঘাটের ঘাঁটা।।........
ঐ শান্ত ছোড়ার মুখ চামাটি /বম্দবস্ত করতে মাটি
গোঁজার উপর দিয়া টাঠি / এ ঘেরয়াছে ঐ পাঁটা।
দিদি দেখতো ভালা। .............
মুখে কেবল ফেলছি থু থু /খিচ্যা লিনু শুয়ারের গু
ঐ অন্তা মড়াক য্যায়া হামি /মারবো দুচার ঝাঁটা।
দিদি দেখতো ভালা। .........
জনৈক বিধবা :: এই গাঁয়েতে লোক /নাই দিদি /কি বলব আর কাখে।
হামার মিনস্যা /ব্যাচা থাকলে দেখতিস আজ তোকে।।
ভোলাহাট গাঁ /ভালো ছিল /পাকিস্তানে চল্যা গেল
আস্যা উঠনু মহদিপুরে
দন্ডবত তোদের খুঁড়ে।
হামার মরদা যদি থাকতুক
তাহলে খোষ গোলকে দেখতুক।
(এমন সময় ওপারের ,পাকিস্তানের গরুর গাড়ির আগমন )
জনৈকা বধূ :: এই মরদা ভারী জিয়দা
কোন দেশে তোর্ বাড়ি।
বলদ দিয়্যা হুড়া মরিস
উপরে লিব তোর্ দাড়ি। ।
গড়িয়া দিলি ভরা কলসি
ডাকত দিদি পারাপর্শী।
দেখবো তুই কেমন গাড়োয়ান
হামার নাম কালানি মারোয়ান।।
ম্যারা ধইরা ক্যারা লিব
বলদ হাঁকা সাঁটা।।
দিদি দেখতো ভালা ........
বাড়তে আস্যে শুনি জঞ্জাল
মাগী ছাগী বেহুদ্দী গ্যাল
পুলিশের হারায় চাল ডাল
তরিতরকারী আর আটা
দিদি দেখতো ভালা ...........
আজ হামরা মিটিং করব
বুড়ি ছুড়ি সবাই জুটবো।
বদ্যার বাড়ি এখনি যাব
চাল আছে আধ ছাঁটা।
দিদি দেখতো ভালা ...............
(সূত্র : প্রতীক পোদ্দার ও ভৈরব দাস ,মহদিপুর ,থানা -ইংরেজ বাজার /দ্র : গম্ভীরা ,পুস্প্জিত রায় )
সুতরাং বোঝাই যায় ভাজোই গানের মধ্যে দিয়ে গ্রামীন নারীদের দৈনন্দিন আটপৌরে কথোপকথন'ই পরিস্ফুট হয়।
No comments:
Post a Comment