জনপ্রিয় লোকনাট্য হিসেবে গম্ভীরা গানের পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা সর্বজনবিদিত। এই লোকআঙ্গিকটি অবশ্যই আনুষ্ঠানিক ;এবং জন্মকাল থেকেই এটি নাট্যধর্মী। গম্ভীরা পার্বন ও অনুষ্ঠানের অনেকগুলি পর্ব বা পর্যায় আছে। ঘটভরা ,ছোট তামাসা ,বড় তামাসা আর বড় তামাসার পরেই বোলবাই বা বোলবাহি নামে পালাধর্মী গান গাইবার রীতি প্রচলিত ছিল। বোলবাহি শব্দটি আঞ্চলিক 'খোট্টা' উপভাষায় আবাহন ,আহ্বান করা ,বোলানো অর্থে ব্যবহৃত হয়। উদ্দিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে ডেকে আনা ,স্বাগত জানানো বা সম্ভাষণ জানানো _____এই শব্দটির প্রধান অর্থ। তবে বামনগোলা -হবিবপুরের কোনও কোনও গ্রামে একে কুচ্ছা ,কির্চা ,কির্ছা বা কেচ্ছাজাতীয় গান বলা হয়। সমাজের যে কোনওব্যাক্তি ___তিনি যত মান্যগন্য বা সম্মানীয় হন না কেন ____যদি কোনও অসামাজিক বা অনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পরেন ,তখন তা গম্ভীরার আলোচনার বিষয় হয় ওঠে। নাচগান ,হাসি -তামাসার মধ্যে দিয়ে এই ব্যাপারটিকে তখন জনসাধারণের সামনে পরিবেশন করা হয়। প্রধানত আঞ্চলিক ঘটনার ভিত্তিতেই এই পালাগুলি রচিত ও গীত হত। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বিশিষ্ট চিন্তানায়ক ও সমাজ সংগঠকদের পরিচর্যায় গম্ভীরা পার্বন ও গান নতুন উদ্দীপনা লাভ করে। অধ্যাপক বিনয় সরকার ,আইনজীবী -ঐতিহাসিক রাধেশচন্দ্র শেঠ ,পন্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি জাতীয়তাবাদী প্রগতিধর্মী চিন্তাভাবনা নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সংগঠিত করেন। অধ্যাপক বিনয় সরকার ও অন্যান্যদের উদ্যোগে গঠিত 'মালদহ জাতীয় শিক্ষা সমিতির (১৯০৭) কার্যক্রমে এই লোক - আঙ্গিকটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যেও জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটে ,স্বাধীনতার জন্য মুক্তি আন্দোলনের প্রেরণা সঞ্চারিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে তাই ,শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রীক ,অনৈতিক কাজকর্মে লিপ্ত নরনারীর অবৈধ সম্পর্কভিত্তিক আদিরসাত্মক পালা পরিবেশনের মধ্যেই বোলবাহি লোকনাট্যের বিষয়বস্তুর পরিধি সীমিত রইলো না। কিছুসংখ্যক দর্শক -পৃষ্ঠপোষক -পালাকার -গীতিকার -গায়ক -অভিনেতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন বিষয় ও আঙ্গিকের অনুশীলন শুরু হল। বলবাহী দলগুলির একদেশদর্শী ,ব্যক্তিকেন্দ্রিক অবৈধপ্রনয় নির্ভর পুরনো বিষয়বস্ত্গুলির উপর নতুন চিন্তাভাবনার অভিঘাত লক্ষ করা গেল। নিন্দিত ব্যক্তিদের সাথে গম্ভীরা পালাকারদের বিরোধ দেখা দিতে লাগলো। অনেকটা এই কারণেও কেচ্ছামূলক পালাভিনয়ের ক্ষেত্রে ভাটা দেখা গেল।ক্রমশ ,'বোলবাহী' নামের পালাগানের অবলুপ্তি ঘটতে লাগল এবং বিষয়বস্তুতে ও গঠন প্রকরণে গম্ভীরা গানের ব্যাপ্তি ও অগ্রগতি ঘটতে লাগল।এছাড়া স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ বোলবাহি গানের বিষয়বস্তুর গতানুগতিকতায় নতুন স্রোতের জোয়ার আনল। এভাবেই সংকীর্ণ ও সীমিত ধারার বোলবাহী গম্ভীরার বিশাল ব্যাপ্তিতে গেল।
এলাকা অনুসারে শিবের আবাহনমূলক আচার -আচরণধর্মী অনুষ্ঠানের ভিন্নতা দেখা যায়। বৈষ্ণবনগর থানার চরিয়ানন্ত্পুর অঞ্চলের দু 'শত বিঘি গোলাপগঞ্জ ,খুবলালটোলা প্রভৃতি গ্রামে বোলবাহি নামে একটি আচার -অনুষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যায়। এই বোলবাহি পর্যায়ের প্রধান প্রধান বিশেষত্বগুলি হল :-
(১)সম্মিলিত ছড়া ,শ্লোক ও গানের মাধ্যমে শিবদ্দেশে ভক্তিনিবেদন ও বন্দনা জ্ঞাপন করা হয় ;
(২)কমপক্ষে সাতজন ভক্ত গম্ভীরা মন্ডপ থেকে সংলগ্ন গ্রামে 'ফুলভাঙ্গা 'অনুষ্ঠান পালন করতে যায়। গৃহস্থ বাড়িতে গিয়ে মরসুমী ফল ও ফুল সংগ্রহ করে। এই আচার পালনের মধ্য দিয়ে গম্ভীরার কাজকর্ম সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা হয় ;
(৩)'সোহারা ' পূজার জন্য কাঁচা বাঁশ ,কলার মোচা ,কঞ্চি ,কলার কাঁদি ,আমের কুঁড়ি ,কচি কাঁঠাল সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহের বিষয়টি এই বোলবাহী পর্যায় ভক্তদের ছড়া গীতি ও শ্লোকাদিতে উল্লিখিত হয় ;
(৪)সংগ্রহ কর্মে নিয়োজিত ভক্তদের একটি করে প্রতীকি পরিচয় পত্র থাকে। যেমন -ফুল ,বেলপাতা ,আমপাতা প্রভৃতি। এই ভক্তদের হাতে খাঁড়া জাতীয় অস্ত্রশস্ত্রাদি থাকে। প্রত্যেকের সঙ্গে একটি করে শঙ্খ থাকে। সংগ্রহকর্মে বাধা প্রাপ্ত হলে তারা পরিচয় প্রতীক দেখায় এবং শঙ্খধ্বণি দেয় ,ফলে গৃহস্থরা সংগ্রহকার্যে আর বাধা দেয় না ;
(৫)ফল -ফুল সংগ্রহ করে গম্ভীরা মন্ডপের নিকটবর্তী কোনও একটি স্থানে এসে শঙ্খ বাজানো হয়। সেই ধ্বণি শুনে ভারপ্রাপ্ত মন্ডল ঢাক -ঢোল কাঁসর বাজিয়ে একটি নতুন বস্ত্রে ভক্তবৃন্দকে আড়াল করে গাম্ভিরায় নিয়ে আসেন ;
(৬)সংগৃহীত ফল -ফুল দেবস্থলে রেখে ভক্তরা নৃত্য করেন ও মাটিতে গড়াগড়ি দেন ;
(৭)সংগ্রহকর্মে নিয়ে যদি কোনো ব্যক্তির পরিচয়পত্র হারিয়ে যায় -সেই ভক্ত ভক্তের মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
এই আচার আচরণ ও বিধিবিধান পালনে নাটকীয় যাদুক্রিয়ার উপাদান লক্ষনীয়। এই উপাদানগুলিকে অনেকে 'Ritualistic Theater' নামে চিহ্নিত করেছেন। বিধিগুলি বর্তমানে প্রায় প্রচলিত নেই বললেই চলে।

No comments:
Post a Comment