কৃষিনির্ভর আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কাছে অন্যতম প্রধান আরাধ্য দেবতা হলেন শিব। শিবকে বলা হয় লৌকিক দেবতা ,লোকপ্রিয় দেবতা এই শিব পূজা বা গম্ভীরা পূজা পার্বনের সময় পালনীয় আচার অনুষ্ঠান এবং বিধিনিয়মের মধ্যে কৃষিমূলক ক্রিয়াকর্মের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ঘটস্থাপনা ,'ঘট বসানো '_____প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মের কথায় শস্যফলন সংক্রান্ত ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। 'গম্ভীরা 'য় বা 'থানে ' নির্দিষ্ট একটি জায়গায় মাটির ঘট বসানো হয়। ঘট বসানোর আগে থানের মাটি খুরে নরম ঝুরঝুরে করা হয়। এই নরম মাটির ওপর ধান,যব,সরিষা,তিসি,ধুতুরা,মুগ,মুসুর,কলাই প্রভৃতি বপন করা হয়। তার ওপর বসানো হয় সেই নতুন ঘট। আচার-অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে অর্থাৎ সাতদিন পর গম্ভীরার মন্ডল বা প্রধান খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করে সবাইকে জানান কোন কোন শস্যবীজ ভালোভাবে অঙ্কুরিত হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে মনে করা হয় ,ভালোভাবে অঙ্কুরিত শস্য গুলি নতুন বছরে বিশেষভাবে আবাদ করতে হবে ,এগুলির ফলন ভালো হবে। যথার্থভাবে অঙ্কুরিত হওয়া এবং গম্ভীরা মন্ডপের 'লক্ষণ বিবেচনা ' করে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করার বিধিনিয়ম সম্পর্কে সকলের বিশ্বাসবোধ কাজ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ,গাজোল-হবিবপুর,বামনগোলা থানার বিভিন্ন জায়গায় 'কিসি' একটি অনুষ্ঠান পালিত হয়। গম্ভীরা পার্বনের তৃত্বীয় দিনে,সূর্যদয়ের আগে এই অনুষ্ঠানের কাজ শুরু হয়। সন্দেহ নেই যে 'কিসি ' শব্দটি 'কৃষি ' শব্দ থেকে এসেছে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি কৃষিকর্মবিষয়ক। খুব ভোরবেলা ভক্তবৃন্দ মিলিত হন গাম্ভিরায়। 'শিবের 'জমি চাষ করবার জন্য ভক্তদের মধ্যে একজন ভক্ত বিশেষ উদ্যোগ নেন এবং মন্ডলের অনুমোদন প্রার্থনা করেন। বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষিকর্মগুলি নাচ -গান সংলাপ অঙ্গভঙ্গি ও বাদ্যবাজনা সহ সমবেতভাবে পরিবেশন করা হয়। লাঙ্গল,বলদ ,বলদ দিয়ে চাষ করা মই দেওয়া ,বপন করা ,রোপন করা ,ধান ঘরে তোলা ,জমির মালিকের কাছ থেকে ফসলের ভাগ নেওয়া ____প্রভৃতি অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থিত করা হয়। এই অনুষ্ঠানের পর ,ওই একই জায়গায় 'ঢেঁকিমঙ্গল ' 'ঢেঁকিমঙ্গলা ' 'ঢেঁকিচুমানো 'বা ঢিকিনাচ অনুষ্ঠিত হয়। 'ঢেঁকিমঙ্গল ' গানে লক্ষীদেবীর আবাহন ,শস্যফলন ,গৃহস্থের আবেদন -নিবেদন এবং কল্যাণ কামনার কথা গানের মাধ্যমে হাজির করা হয়। 'ফুলভাঙ্গা '-'ফলভাঙ্গা ' বিধিপালনের সময় কোনও গৃহস্থ বাড়ির থেকে একটি ঢেঁকি তুলে আনা হয়। কখনও বা ঢেঁকি চুরি করে আনা হয়। বিধিপালন করার জন্য গ্রামান্তরে যাওয়ার সময় প্রধান ভক্তদের কিছু নির্দেশ দেন।
এইসব আচার -অনুষ্ঠান ও বিধিবিধানগুলির মধ্য দিয়ে এলাকার সাধারণ কৃষিকাজ ও কাজের সঙ্গে যুক্ত ফলন ব্যবস্থার অনেক তথ্য জানা যায়। উল্লিখিত 'কিসি ' অনুষ্ঠানটি সেই এলাকার কৃষি সম্পর্কের সঙ্গেই জড়িত। শক্তিসাধনার সঙ্গেও এই গম্ভীরা পার্বন অনুষ্ঠানাদির একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। শক্তির প্রতীক হিসাবে দা ,রামদা ,খাঁড়া প্রভৃতি অস্ত্রকেও গাম্ভিরায় পূজা করা হয়। আত্মপীড়নমূলক কিছু অনুষ্ঠান তীক্ষ্ণ লৌহ শলাকা দিয়ে জিভ ,গাল ফোঁড়া ,পিঠ ফোঁড়া ,কাঁটার উপর নাচ হয়। কালিম্পং এর দশাই মহাপার্বনটি বা শক্তিপূজার সঙ্গে গম্ভীরার মিল পাওয়া যায়। গম্ভীরা পার্বনে ঘট বসবার সময় 'থানে ' যেমন নানারকমের শস্য বীজ বপনের প্রথা পালিত হয় ,দশাই পার্বনের সময়েও ওই একই প্রথা পালন করতে দেখা যায়। এই প্রথার নাম 'জমারা প্রথা '। দশমীর দিন অঙ্কুরিত শস্যবীজের চারাভর্তি সরা মাথায় নিয়ে মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে পথ পরিক্রমায় বের হন। শস্যবীজের এক -একটি ছাড়া হচ্ছে কল্যাণ কামনার বা আশীর্বাদ জ্ঞাপনের পবিত্র উপাদান। বয়স্করা দশমীর দিন ও তার পরের দিন ছোটদের মাথায় ওই শস্যবীজের ছাড়া স্পর্শ করে আশির্বাদ করেন। গম্ভীরা অনুষ্ঠিত হয় চৈত্র -সংক্রান্তিতে ও নববর্ষে আর জমারা হলো শারদীয় পার্বন। উল্লেখ করার মত বিষয় হলো এই যে ,পূর্বে একসময় আমাদের বর্ষারম্ভ হত বিজয়দশমীর দিন থেকে।
No comments:
Post a Comment