Friday, 20 November 2015

Isolation of Gambhira

লোকনাট্য হিসাবে গম্ভীরাগানের নিজস্ব ,স্বতন্ত্র কিছু শৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। আসরের সাজসজ্জায় সাধারণ উপাদান থাকলেও কিছু কিছু আলাদা ব্যবস্থা দেখা যায়। কারণ এই আঙ্গিকটি সূচনা পর্বে ছিল একান্তই আনুষ্ঠানিক, এই আনুষ্ঠানিকতার স্বার্থে আয়োজন ছিল আলাদা। যেমন ,সাদা পদ্মফুলে অন্য কোনও লোকনাটকের আসর সাজাবার প্রয়াস দেখা যায় না। অথচ গাম্ভীরায়ে এটা ছিল অনিবার্য। তাই টাটকা তাজা সাদা পদ্মফুল না পাওয়া গেলে কাগজে তৈরী পদ্মফুলে আসর সাজানো হত। পদ্মফুল এখানে সৌন্দর্যবিধানের জন্যই সুধু ব্যবহৃত হয় ,তা নয় ;পদ্মফুল এখানে বৌদ্ধমতাদর্শগত অনুশীলনের অন্যতম একটি উপাদান ,সাধন প্রক্রিয়ার একটি প্রতীক। এই পদ্মফুল ,কাগজের পদ্মফুল ছাড়াও আলোকসজ্জার ব্যাপারে কিছু বিশেষ প্রযত্ন লক্ষ করা গেছে। ঝাড়বাতি ,ঝাড়লন্ঠনে মোমবাতির সাহায্যে আলোর রোশনাই সৃষ্টি করা হত। 

                                                                        নতুন বাঁশে ,কাঁচা বাঁশের বাতায় আসরের চৌহদ্দি ঘেরা হয় ;আমপাতা ও নানারকমের লতায় পাতায় সাজানো হত। কচি কাঁঠাল ,আমের কুঁড়ি,কলার পাতা ,কলার মোচা ইত্যাদি আসরসজ্জায় কোথাও কোথাও ব্যবহৃত হয়। এখন থেকে পঞ্চাশ -ষাট বছর আগেও রামকেলি মেলায় বিশেষ একধরনের অলংকৃত বস্ত্র পাওয়া যেত। এই বস্ত্রগুলি আসরের চারদিকে টাঙিয়ে রাখা হত। এই বিশেষত্ব গুলি আমাদের অন্য কোনও লোকনাটকের আসরসজ্জায় দেখা যায় না। 

                                                                                        গম্ভীরা  পালাগান পরিবেশনার আর একটি স্বাতন্ত্র্যের কথা বলবার মত ,___কারণ ,পালাগানে আমরা সাধারনত একটি  গোটা কাহিনী বা গল্প শুনতে বা দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু গম্ভীরায় একটি মাত্র কাহিনী পরিবেশিত হয় না। ধারাবাহিক বা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রথিত একটি মাত্র পালা বা অখ্যায়িকার বদলে ,টুকরো টুকরো পালা বা কাহিনী অংশ দেখা যায়। এখানে একটিমাত্র নির্দিষ্ট কাহিনীর প্রাধান্য থাকে না ঠিকই তবে টুকরো টুকরো অনেক কাহিনীর প্রাধান্য থাকে। অর্থাৎ ,পর্ব -বিভাজনের মালায় গাঁথা অনেক কাহিনীর বা ঘটনার সামগ্রিক উপস্থাপন পাওয়া যায় গম্ভীরাগানে। 
                                                                                               এই পালার প্রাথমিক পর্বে অর্থাৎ বন্দনা পর্বে দেবাদিদেব মহাদেবকে সামনে রেখে ,তাঁকে উদ্দেশ্য করে অভাব -অভিযোগ -সুখ -দুঃখের কথা নিবেদন করতে গিয়ে ভক্তগণ রঙ্গতামাসা করেন। গম্ভীরা গানে মহাদেবকে নানা ,বা নানা হে বলে সম্বোধন করা হয়। এইসব এলাকায় নানা অর্থে দাদু বা ঠাকুরদা বোঝায়। দাদু নাতিতে যা সম্পর্ক ,____তাতে সামাজিক বিধি অনুসারে রঙ্গরসিকতার অবকাশ আছে। দেব -চরিত্রকে নিয়ে এত লঘু -রকমের রঙ্গপ্রিয়তা অন্য লোক -নাট্যে  দুর্লভ। 

          লোক -নাট্য হিসেবে গম্ভীরা অবশ্যই স্কেচধর্মী ও খন্ড খন্ড। পথ -নাটকের পূর্বসূরী বলেও পরিচিত। পোস্টার ড্রামার সঙ্গে সঙ্গতিসম্পন্ন। সহজ সরল হাস্যরসাত্মক ভঙ্গির পাশাপাশি তীব্র তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপাত্মক আক্রমনের রেওয়াজ দেখা যায়। 

                      গম্ভীরায় খানগান ,কুশানগান ,দোতরা -পালা প্রভৃতি পালার পরিবেশনে স্বাভাবিক ঢিলেঢালা রীতি দেখা যায়। এর পাশাপাশি গম্ভীরা অবশ্যই গতিময়। গম্ভীরা গানের মত  উল্লেখযোগ্য  illusion আর কোথাও লক্ষ করা যায় না। চামর।,পাকা কলার ছড়ি সহ 'চালনবাতি ',ধূপধূনা ,মুখা প্রভৃতি গাম্ভিরাগানের অলংকরণে অনুপস্থিত। শিব-এর সামগ্রিক মিথটি লোকায়ত নাট্যায়নে ____গম্ভীরায় ,বিশেষ আকর্ষক বাতাবরণ তৈরী করে। 






                                                                  












Friday, 13 November 2015

Gambhira Songs & Folk Theatre

জনপ্রিয় লোকনাট্য হিসেবে গম্ভীরা গানের পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা সর্বজনবিদিত। এই লোকআঙ্গিকটি অবশ্যই আনুষ্ঠানিক ;এবং জন্মকাল থেকেই এটি নাট্যধর্মী। গম্ভীরা পার্বন ও অনুষ্ঠানের অনেকগুলি পর্ব বা পর্যায় আছে। ঘটভরা ,ছোট তামাসা ,বড় তামাসা আর বড় তামাসার পরেই বোলবাই বা বোলবাহি নামে পালাধর্মী গান গাইবার রীতি প্রচলিত ছিল।                                                                                                                                                                                                            বোলবাহি শব্দটি আঞ্চলিক 'খোট্টা' উপভাষায় আবাহন ,আহ্বান করা ,বোলানো অর্থে ব্যবহৃত হয়। উদ্দিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে ডেকে আনা ,স্বাগত জানানো বা সম্ভাষণ জানানো _____এই শব্দটির প্রধান অর্থ। তবে বামনগোলা -হবিবপুরের কোনও কোনও গ্রামে একে কুচ্ছা ,কির্চা ,কির্ছা বা কেচ্ছাজাতীয় গান বলা হয়। সমাজের যে কোনওব্যাক্তি ___তিনি যত মান্যগন্য বা সম্মানীয় হন না কেন ____যদি কোনও অসামাজিক বা অনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পরেন ,তখন তা গম্ভীরার আলোচনার বিষয় হয় ওঠে। নাচগান ,হাসি -তামাসার মধ্যে দিয়ে এই ব্যাপারটিকে তখন জনসাধারণের সামনে পরিবেশন করা হয়। প্রধানত আঞ্চলিক ঘটনার ভিত্তিতেই এই পালাগুলি রচিত ও গীত হত।                                                                                                                                                                                                           বিশ শতকের গোড়ার দিকে বিশিষ্ট চিন্তানায়ক ও সমাজ সংগঠকদের পরিচর্যায় গম্ভীরা পার্বন ও গান নতুন উদ্দীপনা লাভ করে। অধ্যাপক বিনয় সরকার ,আইনজীবী -ঐতিহাসিক রাধেশচন্দ্র শেঠ ,পন্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি জাতীয়তাবাদী প্রগতিধর্মী চিন্তাভাবনা নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সংগঠিত করেন। অধ্যাপক বিনয় সরকার ও অন্যান্যদের উদ্যোগে গঠিত 'মালদহ জাতীয় শিক্ষা সমিতির (১৯০৭) কার্যক্রমে এই লোক - আঙ্গিকটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। 


    স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যেও জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটে ,স্বাধীনতার জন্য মুক্তি আন্দোলনের প্রেরণা সঞ্চারিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে তাই ,শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রীক ,অনৈতিক কাজকর্মে লিপ্ত নরনারীর অবৈধ সম্পর্কভিত্তিক আদিরসাত্মক পালা পরিবেশনের মধ্যেই বোলবাহি লোকনাট্যের বিষয়বস্তুর পরিধি সীমিত রইলো না। কিছুসংখ্যক দর্শক -পৃষ্ঠপোষক -পালাকার -গীতিকার -গায়ক -অভিনেতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন বিষয় ও আঙ্গিকের অনুশীলন শুরু হল। বলবাহী দলগুলির একদেশদর্শী ,ব্যক্তিকেন্দ্রিক অবৈধপ্রনয় নির্ভর পুরনো বিষয়বস্ত্গুলির উপর নতুন চিন্তাভাবনার অভিঘাত লক্ষ করা গেল। নিন্দিত ব্যক্তিদের সাথে গম্ভীরা পালাকারদের বিরোধ দেখা দিতে লাগলো। অনেকটা এই কারণেও কেচ্ছামূলক পালাভিনয়ের ক্ষেত্রে ভাটা দেখা গেল।ক্রমশ ,'বোলবাহী' নামের পালাগানের অবলুপ্তি ঘটতে লাগল এবং বিষয়বস্তুতে ও গঠন প্রকরণে গম্ভীরা গানের ব্যাপ্তি ও অগ্রগতি ঘটতে লাগল।এছাড়া স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ বোলবাহি গানের বিষয়বস্তুর গতানুগতিকতায় নতুন স্রোতের জোয়ার আনল। এভাবেই সংকীর্ণ ও সীমিত ধারার বোলবাহী গম্ভীরার বিশাল ব্যাপ্তিতে গেল। 





                এলাকা অনুসারে শিবের আবাহনমূলক আচার -আচরণধর্মী অনুষ্ঠানের ভিন্নতা দেখা যায়। বৈষ্ণবনগর থানার চরিয়ানন্ত্পুর অঞ্চলের দু 'শত বিঘি গোলাপগঞ্জ ,খুবলালটোলা প্রভৃতি গ্রামে বোলবাহি নামে একটি আচার -অনুষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যায়। এই বোলবাহি পর্যায়ের প্রধান প্রধান বিশেষত্বগুলি হল :-

  (১)সম্মিলিত ছড়া ,শ্লোক ও গানের মাধ্যমে শিবদ্দেশে ভক্তিনিবেদন ও বন্দনা জ্ঞাপন করা হয় ;

 (২)কমপক্ষে সাতজন ভক্ত গম্ভীরা মন্ডপ থেকে সংলগ্ন গ্রামে 'ফুলভাঙ্গা 'অনুষ্ঠান পালন করতে যায়। গৃহস্থ বাড়িতে গিয়ে মরসুমী ফল ও ফুল সংগ্রহ করে। এই আচার পালনের মধ্য দিয়ে গম্ভীরার কাজকর্ম সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা হয় ;

(৩)'সোহারা ' পূজার জন্য কাঁচা বাঁশ ,কলার মোচা ,কঞ্চি ,কলার কাঁদি ,আমের কুঁড়ি ,কচি কাঁঠাল সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহের বিষয়টি এই বোলবাহী পর্যায় ভক্তদের ছড়া গীতি ও শ্লোকাদিতে উল্লিখিত হয় ;


(৪)সংগ্রহ কর্মে নিয়োজিত ভক্তদের একটি করে প্রতীকি পরিচয় পত্র থাকে। যেমন -ফুল ,বেলপাতা ,আমপাতা প্রভৃতি। এই ভক্তদের হাতে খাঁড়া জাতীয় অস্ত্রশস্ত্রাদি থাকে। প্রত্যেকের সঙ্গে একটি করে শঙ্খ থাকে। সংগ্রহকর্মে বাধা প্রাপ্ত হলে তারা পরিচয় প্রতীক দেখায় এবং শঙ্খধ্বণি দেয় ,ফলে গৃহস্থরা সংগ্রহকার্যে আর বাধা দেয় না ;


(৫)ফল -ফুল সংগ্রহ করে গম্ভীরা মন্ডপের নিকটবর্তী কোনও একটি স্থানে এসে শঙ্খ বাজানো হয়। সেই ধ্বণি শুনে ভারপ্রাপ্ত মন্ডল ঢাক -ঢোল কাঁসর বাজিয়ে একটি নতুন বস্ত্রে ভক্তবৃন্দকে আড়াল করে গাম্ভিরায় নিয়ে আসেন ;


(৬)সংগৃহীত ফল -ফুল দেবস্থলে রেখে ভক্তরা নৃত্য করেন ও মাটিতে গড়াগড়ি দেন ;



(৭)সংগ্রহকর্মে নিয়ে যদি কোনো ব্যক্তির পরিচয়পত্র হারিয়ে যায় -সেই ভক্ত ভক্তের মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। 


                                                                              এই আচার আচরণ ও বিধিবিধান পালনে নাটকীয় যাদুক্রিয়ার উপাদান লক্ষনীয়। এই উপাদানগুলিকে অনেকে 'Ritualistic Theater' নামে চিহ্নিত করেছেন। বিধিগুলি বর্তমানে প্রায় প্রচলিত নেই বললেই চলে। 






























































































Thursday, 5 November 2015

Gambhira & Agriculture

কৃষিনির্ভর আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কাছে অন্যতম প্রধান আরাধ্য দেবতা হলেন শিব। শিবকে বলা হয় লৌকিক দেবতা ,লোকপ্রিয় দেবতা এই শিব পূজা বা গম্ভীরা পূজা পার্বনের সময় পালনীয় আচার অনুষ্ঠান এবং বিধিনিয়মের মধ্যে কৃষিমূলক ক্রিয়াকর্মের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ঘটস্থাপনা ,'ঘট বসানো '_____প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মের কথায় শস্যফলন সংক্রান্ত ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। 'গম্ভীরা 'য়  বা 'থানে ' নির্দিষ্ট একটি জায়গায় মাটির ঘট বসানো হয়। ঘট বসানোর আগে থানের মাটি খুরে নরম ঝুরঝুরে করা হয়। এই নরম মাটির ওপর ধান,যব,সরিষা,তিসি,ধুতুরা,মুগ,মুসুর,কলাই প্রভৃতি বপন করা হয়। তার ওপর বসানো হয় সেই নতুন ঘট। আচার-অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে অর্থাৎ সাতদিন পর গম্ভীরার মন্ডল বা প্রধান খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করে সবাইকে জানান কোন কোন শস্যবীজ ভালোভাবে অঙ্কুরিত হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে মনে করা হয় ,ভালোভাবে অঙ্কুরিত শস্য গুলি নতুন বছরে বিশেষভাবে আবাদ করতে হবে ,এগুলির ফলন ভালো হবে। যথার্থভাবে অঙ্কুরিত  হওয়া এবং গম্ভীরা মন্ডপের 'লক্ষণ বিবেচনা ' করে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করার বিধিনিয়ম সম্পর্কে সকলের বিশ্বাসবোধ কাজ করে।                                                                                                                                                                                                             প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ,গাজোল-হবিবপুর,বামনগোলা থানার বিভিন্ন জায়গায় 'কিসি' একটি অনুষ্ঠান পালিত হয়। গম্ভীরা পার্বনের তৃত্বীয় দিনে,সূর্যদয়ের আগে এই অনুষ্ঠানের কাজ শুরু হয়। সন্দেহ নেই যে 'কিসি ' শব্দটি 'কৃষি ' শব্দ থেকে এসেছে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি কৃষিকর্মবিষয়ক।                                                                                                                                                                                                                   খুব ভোরবেলা ভক্তবৃন্দ মিলিত হন গাম্ভিরায়। 'শিবের 'জমি চাষ করবার জন্য ভক্তদের মধ্যে একজন ভক্ত বিশেষ উদ্যোগ নেন এবং মন্ডলের অনুমোদন প্রার্থনা করেন। বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষিকর্মগুলি নাচ -গান সংলাপ অঙ্গভঙ্গি ও বাদ্যবাজনা সহ সমবেতভাবে পরিবেশন করা হয়। লাঙ্গল,বলদ ,বলদ দিয়ে চাষ করা মই দেওয়া ,বপন করা ,রোপন করা ,ধান ঘরে তোলা ,জমির মালিকের কাছ থেকে ফসলের ভাগ নেওয়া ____প্রভৃতি অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থিত করা হয়।                                                                                                                                                                                                                এই অনুষ্ঠানের পর ,ওই একই জায়গায় 'ঢেঁকিমঙ্গল ' 'ঢেঁকিমঙ্গলা ' 'ঢেঁকিচুমানো 'বা ঢিকিনাচ অনুষ্ঠিত হয়। 'ঢেঁকিমঙ্গল ' গানে লক্ষীদেবীর আবাহন ,শস্যফলন ,গৃহস্থের আবেদন -নিবেদন এবং কল্যাণ কামনার কথা গানের মাধ্যমে হাজির করা হয়। 'ফুলভাঙ্গা '-'ফলভাঙ্গা ' বিধিপালনের সময় কোনও গৃহস্থ বাড়ির থেকে একটি ঢেঁকি তুলে আনা হয়। কখনও বা ঢেঁকি চুরি করে আনা হয়। বিধিপালন করার জন্য গ্রামান্তরে যাওয়ার সময় প্রধান ভক্তদের কিছু নির্দেশ দেন। 

                                                                                                                                                           এইসব আচার -অনুষ্ঠান ও বিধিবিধানগুলির মধ্য দিয়ে এলাকার সাধারণ কৃষিকাজ ও কাজের সঙ্গে যুক্ত ফলন ব্যবস্থার অনেক তথ্য জানা যায়। উল্লিখিত 'কিসি ' অনুষ্ঠানটি সেই এলাকার কৃষি সম্পর্কের সঙ্গেই জড়িত।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          শক্তিসাধনার সঙ্গেও এই গম্ভীরা পার্বন অনুষ্ঠানাদির একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। শক্তির প্রতীক হিসাবে দা ,রামদা ,খাঁড়া প্রভৃতি অস্ত্রকেও গাম্ভিরায় পূজা করা হয়। আত্মপীড়নমূলক কিছু অনুষ্ঠান তীক্ষ্ণ লৌহ শলাকা দিয়ে জিভ ,গাল ফোঁড়া ,পিঠ ফোঁড়া ,কাঁটার উপর নাচ হয়।                                                                                                                                                                                                             কালিম্পং এর দশাই মহাপার্বনটি বা শক্তিপূজার সঙ্গে গম্ভীরার মিল পাওয়া যায়। গম্ভীরা পার্বনে ঘট বসবার সময় 'থানে ' যেমন নানারকমের শস্য বীজ বপনের প্রথা পালিত হয় ,দশাই পার্বনের সময়েও ওই একই প্রথা পালন করতে দেখা যায়। এই প্রথার নাম 'জমারা প্রথা '। দশমীর দিন অঙ্কুরিত শস্যবীজের চারাভর্তি সরা মাথায় নিয়ে মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে পথ পরিক্রমায় বের হন। শস্যবীজের এক -একটি ছাড়া হচ্ছে কল্যাণ কামনার বা আশীর্বাদ জ্ঞাপনের পবিত্র উপাদান। বয়স্করা দশমীর দিন ও তার পরের দিন ছোটদের মাথায় ওই শস্যবীজের ছাড়া স্পর্শ করে আশির্বাদ করেন। গম্ভীরা অনুষ্ঠিত হয় চৈত্র -সংক্রান্তিতে ও নববর্ষে আর জমারা হলো শারদীয় পার্বন। উল্লেখ করার মত বিষয় হলো এই যে ,পূর্বে একসময় আমাদের বর্ষারম্ভ হত বিজয়দশমীর দিন থেকে। 





































Friday, 23 October 2015

Masked Dance of Gambhira

গম্ভীরা পূজা কেন্দ্রীক গম্ভীরায় মুখোশ নৃত্য স্থানীয় ভাষায় 'মুখা নাচ' ও গান বর্তমান। তন্মধ্যে গম্ভীরা মুখোশ নৃত্যই প্রাচীনতম। গম্ভীরা মুখোশনৃত্য ;তান্ত্রিক ও ঐন্দ্রজালিক এই নৃত্য গম্ভীরা পূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজরিত। আদিতে নিম ও ডুমুর কাঠ দিয়েই এই সব মুখোশ তৈরী হত। ধর্মীয় আচার যুক্ত এই সব মুখোশ নির্মিতি এবং তার সংরক্ষণ পদ্ধতি রয়েছে। 


                                        বিভিন্ন ধরনের উপাদানে তৈরী মুখোশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ________________________


                                            ১ কাঠের মুখোশ 
                                               ২ মাটির মুখোশ 
                                                  ৩ সোলার মুখোশ 
                                                     ৪ কাগজের মন্ড -এর মুখোশ 
                                                        ৫ লাউএর খোলার মুখোশ 
                                                          ৬ সুপারি গাছের খোলার মুখোশ 
                                                             ৭ পিচ্বোর্ডের মুখোশ  





কাঠের মুখোশ :- মুখোশ নাচ বা মুখা নাচ এ মূলত কাঠের মুখোশ-ই ব্যবহৃত হয়। কাঠের মধ্যে নিম কাঠ'ই ব্যবহৃত হয়। নিম ছাড়া অন্য কাঠের মধ্যে শুধু বেল কাঠের ব্যবহার দেখা যায়। এই দুই ধরনের কাঠ ব্যবহারের নেপথ্যে দুটি কারণ বর্তমান ;যথা :- ১ বিশ্বাস ও সংস্কার অনুসারে নিম ও বেল কাঠ শুদ্ধ ,পবিত্র ও দেবতাদির অর্চনায় সুপ্রচলিত ; এবং 
 ২ নিমকাঠ দীর্ঘকাল টেঁকে। এর আঁশ বেশ শক্ত,তাছাড়া নিমকাঠে কখনও ঘুণ ধরার ভয় থাকে না। 

 মুখানাচ :- গম্ভীরার মুখানাচ সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় হরিদাস পালিত বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। গম্ভীরা নাচের খ্যাতির কথা Bengal Anti-Fascist,Writers &Artists' Association এর রিপোর্টে শ্রী হরেন মুখোপাধ্যায় ও উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী কালে প্রদ্যোত ঘোষ এ বিষয় আরও আলোকপাত করেছেন।  

                   শ্রদ্ধেয়  পালিত মশাই গম্ভীরার আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই গম্ভীরার 'নৃত্যমণ্ডপ'ও সাজসজ্জার স্বাতন্ত্র্যের উল্লেখ করেছেন নৃত্য মন্ডপের যে অংশে নৃত্যগীত অনুষ্ঠিত হয় সেখান কোনপ্রকার আসনের ব্যবস্থা থাকে না ____ অতএব সেখানে যারা অনুষ্ঠান করে তাদের ধুলোর উপরেই নাচ -গান করতে হয়। এই নাচগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং এখনও সেই জনপ্রিয়তা আছে। একই দিনে এবং একই সময়ে বিভিন্ন গম্ভীরায় মুখানাচের অনুষ্ঠান হলে সমৃদ্ধ নৃত্যানুষ্ঠানগুলি সকলেই উপভোগ করতে পারবেন না জেনে এবং কুশলী নর্তকগণের অভাব হয় বলে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে গম্ভীরা অনুষ্ঠান ও নাচ হয়ে থাকে। মন্ডপে রঙিন কাগজের পদ্মফুল দিয়ে সাজসজ্জার ব্যবস্থা করা হত। গম্ভীরা থেকে গাম্ভিরান্তরে যাওয়ার জন্য অনেকগুলি পাটকাঠির গোছা একত্র করে জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হত , এগুলিকে 'উকা ' বলা হয়। 



                                                          গম্ভীরা অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে ছোট তামাশায় 'ভক্তগড়া' এবং 'শিবগড়া' অনুষ্ঠানাদির পর রাত্রিকালে বিবিধ নাচ -গান ও মুখ্যার নাচ হয়। আগে নাচের সময় দর্শকবৃন্দের  সন্তুষ্টি বিধানের জন্য পিচকিরি দিয়ে  গোলাপজল দেওয়া হত। কোনও কোনও সময় রং মশালেরও ব্যবস্থা থাকত। 
   
                     গম্ভীরা অনুষ্ঠানে বড় তামাসার বিবরণ দিতে গিয়ে পালিত বাবু বলেছেন  যে ,কালিঘাটের নীল পুজোর দিনে গাজনের সময় সন্ন্যাসীরা যেমন শোভাযাত্রা করে থাকেন ,এখানেও অনুরূপ আট থেকে আশি সকলেই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। ভূত -প্রেত -প্রেতিনী ,বাজিকর -বাজিকর-স্ত্রী ,সাঁওতাল ,তুবড়িওয়ালা ইত্যাদি যার যেমন ইচ্ছা সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়ে এক গম্ভীরা থেকে আর এক গম্ভীরায় যায়। 


                                   এই অনুষ্ঠানটি সাধারনত দিনের বেলায় হয়ে থাকে। বিগত ষাটের দশকেও দেখা গেছে ,রাত্রে হনুমান মুখা নামে  বিশেষ  আকর্ষনীয় এক নাচ, হনুমানের সমুদ্র পার ও লঙ্কা দহনের ঘটনা যাতে অভিনয় করে দেখানো হত। ওইদিন খুব সকালে সূর্যদয়ের আগে মশাল গম্ভীরা'র জনপ্রিয়তা আজও রয়েছে। 












                                                                             
















Monday, 12 October 2015

Women s' gambhira or Bhajoi Gaaner Pala

মালদা জেলার ইংরেজবাজার ও পূরাতন মালদার অনেক গ্রামে শস্য ফলনের পালা ________ভাজোই গানের পালা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই পার্বন অনুষ্ঠান কালে অর্থাৎ ভাদ্রমাসে অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেয়েরা নিজেদের পছন্দ মত বিষয়বস্তু অবলম্বন করে নাচ-গান -অভিনয়াদি করতেন।                                                                                                                                                                                        
                                                                          বর্তমানে ,ভাজোই গান -ভাজোই অনুষ্ঠান খুব কম পরিবারে অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েরাও সেক্ষেত্রে নিজেরা অভিনয় করেনা বললেই চলে।  গৃহস্থ বাড়ির ভিতরে ,গোপনে মেয়েরা পালাভিনয়ের ব্যবস্থা করতেন।  যাতে অভিনয়কালে কোনভাবে পুরুষরা উপস্থিত থাকতে না পারেন সে জন্য আগে ভাগেই ব্যবস্থা করা হত।  তবে পুরুষদেরও ভাজোই গানের পালার ক্ষেত্রে সমর্থন বা অধ্যেষণ -এর অভাব ছিলনা।  


       
     নাচ -গান - বাজনা - সংলাপ এর সাথে অভিনীত পালাগুলি মেয়েরা নিজেরাই বাঁধতেন।  সাধারনত ঢোলক ও জুড়ি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। 
চরিত্র অনুযায়ী নিজেরাই সাজসজ্জা করতেন। এই পালাগুলিকে 'ভাজোই গানের পালা ' বা 'মেয়েদের গম্ভীরা 'বলা হত।     


                                                      
                                                   শস্য ফলনমূলক ,নারীকেন্দ্রিক ব্রতানুষ্ঠানের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে এই লোকনাট্যে যৌনাচারসূচক অঙ্গভঙ্গির উপাদানের কথা অনুমান করা অসঙ্গত নয়।  বিশেষ ভাবে বলা দরকার ,যে , গ্রামীন নারীসমাজের নিজস্ব উদ্যোগে রচিত ও প্রযোজিত লোকনাট্যের নিদর্শন দুর্লভ। এদিক থেকে ,গ্রামীন নারীসমাজের বিশেষ সৃষ্টিমুলকতার নিদর্শন হিসাবে 'মেয়েদের গম্ভীরা 'র গুরুত্ব আছে।  




        এরূপ দুটি  পালা হল :_______________                                                         


                        পালা ১::চুড়িওয়ালা ও গৃহস্থবধূ 





   চুড়িওয়ালা ::  আমি কাঁচের চুড়ি ফেরি করি 
                         বেড়াই লোকের বাড়ি বাড়ি 
                         তোরা চুড়ি লিবিগে।  


      গৃহবধূ ::  এসো এসো চুড়িয়ালা 
                     এসো আমার বাড়ি 
                   যদি থাকে মনের মতো 
                       চুড়ি লিতে পারি।  

 চুড়িওয়ালা :: আমি কাঁচের চুড়ি ফেরি করি 
                        বেড়াই লোকের বাড়ি বাড়ি 
                        তোরা চুড়ি লিবিগে..........
              আছে চুড়ি বেলুয়ারী আর হীরাকাট 
             আয়না বসা কাঁচের রুলি ,বসন্ত বাহার 
                    আমি বলব কতোই আর।  

   
  গৃহবধূ :: আমার স্বামী নাই বাড়িতে 
               গেছেন তিনি ছোঞ্চ আনিতে।  
                টাকা পয়সা নাইকো হাতে 
                  উপায় কি করি।  
                 এসো আমার বাড়ি।




চুড়িওয়ালা :: তুমি এসে বোসনা ,দাম লাগবে না 
                       কি কি লিব্যা বলো না।  
                      চুড়ি আছে ডালিম দানা









     পালা  ২:: নদীর ঘটে যেতে যেতে গৃহস্থ নারীগণের কথোপকথন 

  
   জনৈকা বধূ : দিদি দেখতো ভালা /এ কুন জ্বালা /ক্যামনে যাবে হাঁট 
                        ঐ রজনা মিনসা /উইড়া আসা /ঘেরলে ঘাটের ঘাঁটা।।........
                       ঐ শান্ত ছোড়ার মুখ চামাটি /বম্দবস্ত করতে মাটি  
                       গোঁজার উপর দিয়া টাঠি / এ ঘেরয়াছে ঐ পাঁটা।
                         দিদি দেখতো ভালা। .............


                 মুখে কেবল ফেলছি থু থু /খিচ্যা লিনু শুয়ারের গু    
              ঐ অন্তা মড়াক য্যায়া হামি /মারবো দুচার ঝাঁটা।   
                  দিদি দেখতো ভালা। .........



জনৈক বিধবা :: এই গাঁয়েতে লোক /নাই দিদি /কি বলব আর কাখে। 
                         হামার মিনস্যা /ব্যাচা থাকলে দেখতিস আজ তোকে। 
                          ভোলাহাট গাঁ /ভালো ছিল /পাকিস্তানে চল্যা গেল  
                                   আস্যা উঠনু মহদিপুরে 
                                    দন্ডবত তোদের খুঁড়ে। 
                                হামার মরদা  যদি থাকতুক 
                               তাহলে খোষ গোলকে দেখতুক।  

            (এমন সময় ওপারের ,পাকিস্তানের গরুর গাড়ির আগমন )



জনৈকা বধূ :: এই মরদা ভারী জিয়দা 
                      কোন দেশে তোর্ বাড়ি।  
                      বলদ দিয়্যা হুড়া মরিস
                      উপরে লিব তোর্ দাড়ি।  
                  গড়িয়া দিলি ভরা কলসি 
                   ডাকত দিদি পারাপর্শী।  
               দেখবো তুই কেমন গাড়োয়ান 
              হামার নাম কালানি মারোয়ান।
                ম্যারা ধইরা ক্যারা লিব  
                    বলদ হাঁকা সাঁটা।।    
                 দিদি দেখতো ভালা    ........



              বাড়তে আস্যে শুনি জঞ্জাল
              মাগী ছাগী বেহুদ্দী গ্যাল
             পুলিশের হারায় চাল ডাল 
             তরিতরকারী আর আটা 
              দিদি দেখতো  ভালা   ...........




             আজ হামরা  মিটিং করব      
             বুড়ি ছুড়ি সবাই জুটবো।  
            বদ্যার বাড়ি এখনি যাব 
            চাল আছে আধ ছাঁটা।  
             দিদি দেখতো ভালা    ...............
           
                                                         (সূত্র : প্রতীক পোদ্দার ও ভৈরব দাস ,মহদিপুর ,থানা -ইংরেজ বাজার /দ্র : গম্ভীরা ,পুস্প্জিত রায় )

     
                                                        সুতরাং বোঝাই যায় ভাজোই গানের মধ্যে দিয়ে গ্রামীন নারীদের দৈনন্দিন আটপৌরে কথোপকথন'ই পরিস্ফুট হয়।  












Sunday, 27 September 2015

Gambhira Song

গম্ভীরা গান। শতবর্ষ পূর্বে গম্ভীরা পূজার সঙ্গে আজকের গম্ভীরা গানের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ তখন আহারা'র সঙ্গে যুক্ত সামাজিক জীবনের একটি বিবরণ দেওয়া হত প্রশ্ন - উত্তর এর মাধ্যমে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের পর লোকসমাজের রুচির তাগিদে এটি লোক -নাট্যের রূপ নিয়েছে।                                                                                             
                                          গম্ভীরা গানে সমাজনীতি ,রাজনীতি ও ধর্মনীতির প্রতিফলন ঘটেছে। গ্রামের নিরক্ষর ও অর্ধশিক্ষিত লোক -কবিরা গম্ভীরা গানের মধ্য দিয়ে সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধ্যে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এক সময় বহু লোক -কবি ও শিল্পীকে স্বদেশী আন্দোলনের জন্য বিদেশী সরকারের কোপানলে পড়ে শাস্তি পেতে হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তো গান স্তব্ধ হয়ে যায়েনি। তারা বিভিন্ন সময় পারিপার্শ্বিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে চলেছেন।                                                                                           
                   গম্ভীরা গানের অনুষ্ঠানে কয়েকটি ভাগ আছে। _________মুখপাদ ,বন্দনা ,দ্বৈত ,চরাইয়ারী , পালাবন্দী গান ,খবর বা রিপোর্ট। আদিতে এ গানের অনুসঙ্গ ছিল ঢোলক ,পরবর্তীকালে হারমোনিয়াম ,বাঁশি ,তবলা ও জুড়ি'ও যুক্ত হয়ছে। তবে  গানের সঙ্গে সংলাপ ও রঙ্গরসিকতায় সেটি লোক -নাট্যের এক বলিষ্ঠ প্রতিনিধি হয়ে দেখা দিয়েছে।                    
                                                                     বিভিন্ন সুরের সংমিশ্রণে গম্ভীরা গানের সুর সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে আলকাপ ,রামপ্রসাদী ,বাউল ,কীর্তনের ঢং ও আছে। তবে এর সুর সৃষ্টিতে অমৃতি গ্রামের লোহারাম খালিফার অবদান সর্বাধিক।  কিন্তু ধর্মীয় বিষয়বস্তু থেকে ধর্মনিরপেক্ষ জগতে এ গানকে আনার ব্যাপারে দুই মুসলীম গম্ভীরা গান লেখক  মহম্মদ সুফী ও সেখ সোলেমানের কৃতিত্ব সর্বাধিক। মালদার লোকায়ত ভাষায় আবাল -বৃদ্ধ -বনিতাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তুতে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে হাস্য রসের মোড়কে এ গান এক অনন্য লোক -শিক্ষার মাধ্যম সন্দেহ নেই।                                                                                                                                                                                                               এ পর্যন্ত উল্লেখ্য রচনাকারের মধ্যে রয়েছেন হরিমোহন কুন্ডু ,মহম্মদ সুফী ,সেখ সোলেমান ,সতীশ কবিরাজ ,গোপীনাথ শেঠ প্রমূখ ব্যাক্তিরা।                                                                                                                                                                                                  
                                      স্বরাজ যদি পাই হে ভোলা 
                                খ্যাতে দিব মানিককলা ,নইলে আইট্যা কলা 
                         বানিয়া হইল দ্যাশপতি ,কি বলব ভাই দ্যাশের গতি।   
                    কাঁচ দিয়ে কাঞ্চনাদি নেয় (যেন )হাতে দিয়ে মাটির খোলা।                                                                                                                                                                                                                                                                                            মালদার গম্ভীরা গানের মধ্য দিয়ে লোক -কবিরা পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। গম্ভীরা গানে লোক -কবিদের মধ্যে যেমন জাতীয়তাবোধের উন্মেষ দেখা যায়ে অপর দিকে ,সংকীর্ণ ধর্মীয় সংস্কারের উর্দ্ধে তাদের সমাজ সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। অনার্য সমাজে লৌকিক শিবের কৃষিকার্য ও ভিক্ষাবৃত্তি  অবলম্বন আমরা এই গানের মধ্যে দেখতে পাই। এখানে শিব উর্বরতা বৃদ্ধির দেবতা হিসেবে পরিচিত।  এই শিব'ই রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে।  












       















Sunday, 20 September 2015

Rituals of Gambhira

মালদায় প্রচলিত এই গম্ভীরা পার্বনটি চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে শুরু হয় ও  চলে বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। চৈত্র-সংক্রান্তি ও তার পূর্বের চারদিনের এই পূজার মধ্যে রয়েছে :-                                                                                                                ১.প্রথম দিন -২৬শে চৈত্র  -ঘট ভরা;                                                            ২.দ্বিতীয় দিন -২৭শে চৈত্র - ছোট তামাশা;                                                  ৩.তৃতীয় দিন -২৮শে চৈত্র - বড় তামাশা;                                                 ৪.চতুর্থ দিন -২৯শে চৈত্র - আহারা(বোলাই/বোলবাই)                                                                                              

                        -:  প্রথম দিন -২৬শে চৈত্র - ঘট ভরা  :-                                                    

 গম্ভীরা পার্বনের একদম প্রথম দিনটি শুরু হয় 'ঘট ভরা ' দিয়ে। 'ঘট ভরা' অর্থাৎ ঘট প্রতিষ্ঠা করে গম্ভীরা মন্ডপে শিব পুজো হয়। এই অনুষ্ঠানে কেবল ব্র্রাম্হনরাই অংশগ্রহণ করেন। তবে , এই অনুষ্ঠানটি মূল অনুষ্ঠানের ক'দিন আগে হবে সেটি দলের প্রধান স্থির করেন। তবে সাধারনত তিনদিন আগেই হয়। সন্ধ্যেবেলায় সূর্য অস্ত যাওয়ার পর একজন ব্রাম্হন ঘট ভরেন ,সেই জল ভর্তি ঘট মন্ডপে পূর্ব-পরিকল্পিত স্থানে রাখা হয়। এদিন অন্য আর কোনো অনুষ্ঠান হয় না।                                                                                                                                                                                                                

                    -:  দ্বিতীয়  দিন  - ২৭শে  চৈত্র  - ছোট  তামাশা  :- 

                                                                                                             দ্বিতীয় দিন হয় ছোট তামাশা। ছোট তামাশা শুরু হয় শিব অথবা 'হর -গৌরীর ' বন্দনা দিয়ে। ছোট ছোট ছেলেরা সন্যাসীর বেশ নেয়। এদের বলা হয় 'বাল  ভক্ত ' । এই 'বাল ভক্ত 'রা শিবের সামনে দাড়িয়ে 'শিব - বন্দনা ' করে। এবং প্রত্যেকে একপায়ের উপর দাড়িয়ে শিব -মন্ত্রোচ্চারণ করে। এরপর দলগত বা একক নৃত্য পরিবেশন করে। এদিন মুখোশ নৃত্য'ও অনুষ্ঠিত হয়।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                     

            -:   তৃতীয়  দিন  - ২৮শে  চৈত্র  - বড়  তামাশা  :-


তৃতীয় দিনে অর্থাৎ বড় তামাশার দিনে অতি শুদ্ধ চিত্তে ও শুদ্ধাচারে শিব ভক্তরা কাঁটাভাঙ্গা ও ফুলভাঙ্গা অনুষ্ঠান করে। শিবের ভক্তরা সংযমী উপোসী হয়ে ঐ মন্ডপে রক্ষিত কাঁটা গাছ বুকে ধারণ করে এবং পরে কাঁটার বিছানায় শয়ন করে। তাছাড়া ওই দিনই বিকেলে বাণ ফোঁড়া পর্বে শিবের ভক্তরা লোহার তৈরী ত্রিশূলের সূক্ষভাগ কোমরে বিদ্ধ করে তেল ভেজানো কাপড় জড়িয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন যত বেশি জ্বলতে থাকে বাদ্যাদি সহ গম্ভীরার নাচ তত জোর হতে থাকে। এইদিনেই নানা অঞ্চলে এই উপলক্ষ্যে সঙ বেরোয়। এই সঙের মধ্য দিয়েই সামাজিক দুর্নীতির কথা লোক সমাজে প্রচারিত হয়। তাই এর একটা সামাজিক মূল্য রয়েছে। এ দিন সারা রাত ধরে মন্ডপে মুখোশ পরে শিব-দূর্গা ,রামলাক্ষন প্রভৃতির নাচ চলে। 

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

                   -:   চতুর্থ দিন  - ২৯শে  চৈত্র  - আহারা    :-                                                                                                                                       

চতুর্থ দিনে গম্ভীরা মন্ডপে শিবপূজা ও নীলপূজার ব্যবস্থা থাকে। রাত্রিতে গম্ভীরা গান বা বোলাই গান হয়। এ গানে মালদহের স্থানীয় ভাষা ও লোকসঙ্গীতের সুর স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে ,এই গানের বিষয় বস্তু'কে 'মুদ্দা' বলে। নাটকীয় ভঙ্গীতে সাধারণ সাজে প্রথমে শিববন্দনা ,পরে অভনয় ও পালাগানের শেষে বছরের বিবরণী গাওয়া হয়। নিজস্ব গম্ভীরা ছাড়া 'ছত্রিশী 'বা 'বারওয়ারী ' গম্ভীরা গানেরও প্রচলন রয়েছে। 

                                                                                                             




                                                       অবিভক্ত  মালদার  ভোলাহাট ,শিবগঞ্জ এর পীঠস্থান। কর্তিত মালদা জেলার অহিহো ও পুরাতন মালদা অঞ্চলে আজও এর ঐতিহ্য বর্তমান। তবে লৌকিক দেবতার চেহারা এর মধ্যে থাকায়ে এক এক অঞ্চলে তার পূজার দিন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নির্দিষ্ট। চার -দশক আগেও মালদা জেলার এটি জাতীয় পার্বন হিসেবে মর্যাদা পেত। 










Wednesday, 16 September 2015

Origine of Gambhira

 আমরা বাঙালিরা স্বভাবগত ভাবেই অনুষ্ঠানপ্রেমি। কথাতেই আছে  বাঙালির "বারো মাসে তের পার্বন "।বাঙলার চিরাচরিত অনুষ্ঠান গুলির প্রায়ে সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়ে আধ্যাত্মিকতা এবং লৌকিক শিল্প-সংস্কৃতি ____সব যেন মিলে মিশে গেছে। 
                                                                                চৈত্র -সংক্রান্তিতে এই লোকায়ত                                                                   বাঙালার গাজন -চরক'ই মালদায়ে                                                              "গম্ভীরা "নামে খ্যাত।মধ্যযুগে 'মন্দির' বা 'দেব্গৃহ 'কে গম্ভীরা বলা হত। কিন্তু 'গম্ভীরা' পূজা বা অনুষ্ঠান কোনোটাই মন্দিরে হত না। "সুর্যপুজা" যা পরবর্তীতে শৈব ধর্মের প্রভাবে 'শিব্পুজায়' রুপান্তরিত হয়েছে,এবং সেই সূর্য পুজোর জন্য গামার কাঠের পিড়ি ব্যাবহিত হয়। এই গামার শব্দটিই হয়তো গম্ভীরা'তে রুপান্তরিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। 
                    কেউ কেউ আবার বলেন 'গম্ভীর' শব্দ থেকে 'গম্ভীরা' কথাটি এসেছে। শিবকে 'গম্ভীর' আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। এটি মুলত শিব বা মহাদেব কেন্দ্রীক ,তাই শিব কে উপলক্ষ্য করে মালদায় যে অনুষ্ঠান প্রচলিত তাই হল "গম্ভীরা" । 
         শিব কে বুদ্ধ মুর্তির'ই সু -সংস্কৃত রূপ বলে মনে করা হয়। শৈব ধর্মের গভীর প্রভাবে ও প্রাচুর্যতাতেই বুদ্ধ মূর্তি শিব মূর্তিতে রুপান্তরিত হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাংলায় পাল রাজাদের সময় শিব ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি হতে হতে বর্তমানে শিবের পূজা ও অনুষ্ঠান গুলি শিবের 'গাজন' 'নীল','গমীরা'এবং 'গম্ভীরা ' নামে পরিচিত হয়েছে।   
                                               মূলত ইন্দো -মঙ্গলীয় ভুক্ত কোচ ,রাজ -বংশী ,পালিয়া ,মাহালি ,বাগদী ,কেওট ,নুনিয়া ,চামার ,পোদ ,নাগর ,ধনুক,চাই ,তুরী ইত্যাদি অবর্ণ হিন্দুরা এর আদি -পূজক হলেও পরবর্তীকালে এবং ইদানিংকালে এর পুজো ও অনুষ্ঠানে অন্যান্য সম্পদায়ের মানুষরাও অংশগ্রহন করেন। 
                                         দীর্ঘ দেড় হাজার বছরের এই "গম্ভীরা"র  উল্লেখ হিউ -এন -সাং এর বিবরনিতেও পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত হিউ-এন-সাং এর গ্রন্থে এ বিষয়ে অনেক তথ্যও পাওয়া যায়।